মারাঠা শক্তির উত্থান

শিবাজী

  • শিবাজী ভোঁসলে অথবা ছত্রপতি শিবাজী রাজে ভোঁসলে হলেন মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
  • শিবাজি ১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে ( ফেব্রুয়ারী ১৯ ) পুনের শিবনেরি পার্বত্য দুর্গে জন্মগ্রহণ করেন। (মতান্তরে তিনি ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন )
  • তার পিতা শাহজী ভোঁসলে ছিলেন বিজাপুর রাজ্যের অধীন পুণার জায়গীরদার।
  • মাতা জীজাবাঈ এবং দাদাজী কোণ্ডদেবের অভিভাবকত্বে শিবাজী তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেন ।
  • ধর্মপরায়ণ মায়ের কাছে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী শুনে শিশুকালেই শিবাজীর মনে বীরত্ব ও দেশপ্রেমের সঞ্চার হয়েছিল।
  • শিবাজী ধর্মীয় গুরু রামদাস এবং তুকারামের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন।
  • শিবাজী ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুরের শাসকের কাছ থেকে তোর্না দুর্গ দখল করেন এবং রাজগড়, প্রতাপগড় ও রায়গড়ে তিনি একাধিক দুর্গও নির্মাণ করেন।
  • শিবাজীকে শায়েস্তা করার জন্য বিজাপুর সুলতান তার পিতা শাহজীকে বন্দি করেন । শেষ পর্যন্ত শিবাজী তিনটি দুর্গ প্রত্যর্পণ করেন ও ভবিষ্যতে দুর্গ দখল করবেন না — এই প্রতিশ্রুতি দিলে শাহজী মুক্তি পান ।
  • ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী চন্দ্ররাও মােরে নামক এক ক্ষমতাশালী জমিদারকে হত্যা করে জাবলী বা সাতারা দখল করেন । এর ফলে মােরে পরিবারের সঞ্চিত বহু ধনসম্পদ শিবাজীর হস্তগত হয় । এ ছাড়া জাবলীর বিরাটসংখ্যক মাওলী সেনাবাহিনীও শিবাজীর হস্তগত হয় ।
  • প্রতাপগড়ের যুদ্ধ ( ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দ) : ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুরের সুলতান আলি আদিল শাহ, শিবাজীকে দমন করার উদ্দেশ্যে আফজল খাঁ-কে প্রেরণ করেন। আফজল খাঁ শিবাজীর অনেক গুলি দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন । কিন্তু ‘ পার্বত্য মুষিক ’ শিবাজী গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন । এই অবস্থায়আফজল খাঁ কূটকৌশলে শিবাজীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেন। এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে শিবাজী তাঁর ' বাঘনখ ' ও ‘ বিছুয়া ’ নামক ছুরি দ্বারা আফজল খাঁকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। শিবাজী কোলাপুর ও উত্তর কোঙ্কন দখল করেন ।
  • স্বাধীন শাসকের স্বীকৃতি : ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুরের সুলতান, শিবাজীকে স্বাধীন শাসক রূপে স্বীকৃতি জানিয়ে তাঁর সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করেন। বিজাপুর রাজ্যের অধীনে থাকা যে সমস্ত অঞ্চল শিবাজী দখল করেছিলেন তার নিয়ন্ত্রণ শিবাজীকে প্রদান করা হয়।
  • শায়েস্তা খাঁ দমন : শিবাজীর উত্থানে উদ্বিগ্ন হয়ে, তাকে দমন করার উদ্দেশ্যে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁকে প্রেরণ করেন শিবাজীকে দমন করতে। কিন্তু শায়েস্তা খাঁর শিবিরে শিবাজী রাত্রিবেলায় অতর্কিত হামলা করেন। এই হামলায় শায়েস্তা খাঁ আহত হন এবং শায়েস্তা খাঁর পুত্র নিহত হন। এই ঘটনায় শায়েস্তা খাঁর ওপর রেগে গিয়ে ঔরঙ্গজেব শায়েস্তা খাঁকে শাস্তিস্বরূপ বাংলায় পাঠিয়ে দেন।
  • পুরন্দরের সন্ধি : ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী মুঘলদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর সুরাট দখল করে নেন । এই ঘটনায় ঔরঙ্গজেব রেগে গিয়ে অম্বরের রাজা জয়সিংহ ও দিলের খাঁকে মারাঠা সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে প্রেরণ করেন। রাজা জয়সিংহ ও দিলের খাঁ প্রস্তুতিসহ শিবাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং সুকৌশলে পুরন্দর দুর্গ ঘিরে ফেলেন। ফলস্বরূপ ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী বাধ্য হন মুঘলদের সাথে পুরন্দরের সন্ধি স্বাক্ষর করতে। এই চুক্তির ফলে শিবাজী –
    • মুঘল সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেন।
    • তার ৩৫টি দুর্গের মধ্যে ২৩টি মুঘলদের দিতে বাধ্য হন। ১২টি দুর্গ শিবাজীকে দেওয়া হয় মুঘলদের প্রতি অনুগত থাকার প্রতিশ্রুতিতে।
    • শিবাজীর পুত্র শম্ভুজী মুঘল দরবারে ৫ হাজারি মনসবদার নিযুক্ত হন।
    • বিজাপুরের বিরুদ্ধে মুঘলদের সাহায্য-দানে সম্মত হন।
  • স্বপুত্র বন্দি : ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমন্ত্রণে শিবাজী এবং তাঁর পুত্র শম্ভুজী আগ্রা দুর্গে যান। সেখানে ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে অপমান করেন এবং শিবাজীকে স্বপুত্র গৃহ বন্দী করা হয়। ঔরঙ্গজেবের পরিকল্পনা ছিল শিবজীকে কান্দাহারে প্রেরণ করা। কিন্তু শিবাজী এবং শম্ভুজী সুকৌশলে পালকি বহনকারী ছদ্মবেশে মুঘল নজরদারি এড়িয়ে পালিয়ে যান। কোনোভাবেই পরাজিত করা সম্ভব নয় দেখে ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে “রাজা” বলে স্বীকার করেন এবং বেরার দান করেন।
  • দুর্গ পুনরুদ্ধার : ১৬৬৭ থেকে ১৬৬৯ খ্রিস্টাব পর্যন্ত শিবাজী লুকিয়ে থাকেন এবং গোপনে সেনাবাহিনী তৈরী করতে থাকেন। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী তার অনেক দুর্গ আবার মুঘলদের কাছ থেকে দখল করে নেন এবং সুরাট বন্দর দ্বিতীয়বারের জন্য দখল করে নেন। ১৬৭২ সালে সালহারের যুদ্ধে শিবাজীর কাছে মুঘল সেনাবাহিনী পরাজয় বরণ করে এবং ধীরে ধীরে শিবাজী পুরন্দরের সন্ধির মাধ্যমে হস্তান্তরিত দুর্গগুলি মুঘল নিয়ন্ত্রণ থেকে পুনরুদ্ধার করেন।
  • রাজ্যাভিষেক : ১৬৭৪ সালে, রায়গড়ের দুর্গে, মহাসমারােহে শিবাজীর রাজ্যভিষেক সম্পন্ন হয়। শিবাজী সিংহাসনে আরােহণের পূর্বে ‘ছত্রপতি’ এবং ‘গাে ব্রাহ্মণ প্রজা পালক’ উপাধি ধারণ করেছিলেন।
  • ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে,মাত্র ৬ বছর রাজত্ব করে ৫০ বছর বয়সে শিবাজীর মৃত্যু হয়।

শাসনব্যবস্থা : শিবাজীর শাসনব্যবস্থায় ছত্রপতি অর্থাৎ রাজার পরেই ছিল ‘অষ্টপ্রধান’ এর স্থান । ‘অষ্টপ্রধান’ বলতে আটজন মন্ত্রী বােঝায়, যাঁরা ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। এই ৮ জন মন্ত্রী হলেন—

  • পেশােয়া বা প্রধানমন্ত্রী, ইনি সমগ্র শাসনব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং রাজার অবর্তমানে তিনি তার প্রতিনিধিত্ব করতেন ।
  • অমাত্য ছিলেন অর্থমন্ত্রী , রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব তিনি রাখতেন ।
  • ওয়াকিনবিস রাজার প্রাত্যহিক কাজকর্ম ও দরবারের ঘটনাবলী নথিবদ্ধ করে রাখতেন ।
  • সর্নাবিশ বা সচিব, সরকারি নথিপত্র লিপিবদ্ধ করতেন ।
  • সুমন্ত বা দাবির, এর কাজ ছিল রাষ্ট্রের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করা ।
  • সব-ই-নৌকত বা প্রধান সেনাপতি
  • পণ্ডিত রাও বা দানাধ্যক্ষ ধর্ম বিষয়ে ও সরকারি দান-ক্ষয়রাতের বিষয়ে পরামর্শ দিতেন ।
  • ন্যায়াধীশ বা কাজি-উল-কাজাৎ বিচারবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন ।

বর্গী ও শিলাদার : শিবাজীর অশ্বারােহী বাহিনী দু-ধরনের সৈন্য নিয়ে গঠিত।

  • পাগা বা বর্গী ছিল শিবাজীর নিজস্ব অশ্বারোহী বাহিনী| বর্গীরা নিয়মিতভাবে সরকারের কাছ থেকে বেতন পেতেন| তাছাড়া অস্ত্র-শস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অশ্ব সরকারি তরফ থেকে তাদের দেওয়া হতো| বর্গীরা প্রায় ৪০ হাজার সেনা নিয়ে গঠিত ছিল|
  • অনিয়মিত সেনাদের বলা হতো শিলাদার| যুদ্ধের প্রয়োজনে সরকার তাদের সাময়িকভাবে নিয়োগ করতো| শিলাদাররা নিজের দায়িত্বে যুদ্ধের সরঞ্জাম অস্ত্র-শস্ত্র, অশ্ব ও অন্যান্য যুদ্ধের উপকরণ জোগাড় করতো| বিনিময় সরকার তাদের একটি মোটা অংকের টাকা প্রদানে বাধ্য থাকতেন|

শিবাজীর শাসন তান্ত্রিক বিভাগ

  • শিবাজী তার স্বরাজ্যকে ১৪ টি প্রান্ত বা প্রদেশে বিভক্ত করেন । প্রান্তের শাসনকর্তাকে বলা হত ‘ মামলাতদার ’ । এঁকে সাহায্য করতেন ‘ কম্ভিসদার ’ নামক কর্মচারী । প্রান্তগুলিতেও আটজনের একটি করে পরামর্শদাতা সভা থাকত ।
  • প্রতিটি প্রান্ত একাধিক তরফে বিভক্ত ছিল । তরফের শাসনকর্তাকে বলা হত কারকুন বা হাবিলদার ।
  • তরফগুলি আবার বহুসংখ্যক গ্রামে বিভক্ত ছিল । গ্রাম-সমিতিগুলিই গ্রামের শাসন পরিচালনা করত । সরকার ও গ্রামের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করত প্যাটেল নামক কর্মচারী । গ্রাম-সমিতিই প্যাটেল নির্বাচিত করত ।

শিবাজীর রাজস্ব ব্যবস্থা

  • শিবাজী আহম্মদনগরের মালিক অম্বরের প্রথাকে অনুসরণ করেই তার ভূমি রাজস্ব নীতি ঠিক করেন ।
  • রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপ করে উৎপন্ন ফসলের শতকরা ত্রিশ ভাগ রাজস্ব ধার্য হয় । পরে এই পরিমাণ বাড়িয়ে শতকরা চল্লিশ ভাগ করা হয় ।
  • শস্যে অথবা নগদ অর্থ রাজস্ব দেওয়া যেত ।

চৌথ ও সরদেশমুখী :

  • শিবাজী প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে তাদের আয়ের এক চতুর্থাংশ কর হিসেবে নিতেন এবং বদলে তাদের শত্রুদের আক্রমণের কত থেকে রাখা করার প্রতিশ্রুতি দিতেন। এই কর চৌথ নামে পরিচিত ছিল ।
  • দাক্ষিণাত্য ও তৎসংলঙ্গ এলাকাতে শিবাজী সরদেশমুখী কর নিতেন। সরদেশমুখী কর ছিল মোট আয়ের একের দশ অংশ।

শম্ভুজী ( ১৬৮১ – ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দ )

  • শিবাজীর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র শম্ভুজী মারাঠা সিংহাসনে আরােহণ করেন।
  • অনেক মারাঠা প্রধান শম্ভুজীর পরিবর্তে শিবাজীর অন্য পুত্র রাজারামকে সমর্থন করেছিলেন। এর ফলে মারাঠাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং মারাঠা সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পরে।
  • শম্ভুজীর ডাক নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কালুশা’ যার অর্থ – কলহের সৃষ্টিকর্তা।
  • ঔরঙ্গজেবের বিদ্রোহী পুত্র আকবরকে শম্ভুজী আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই অপরাধে ঔরঙ্গজেব শম্ভুজীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং শম্ভুজীর শিশুপুত্র দ্বিতীয় শিবাজী(জনপ্রিয় নাম শাহ্’)-কে কারারুদ্ধ করেন।

রাজারাম ( ১৬৮৯ – ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ )

  • শম্ভুজীর মৃত্যুর পর মারাঠা সিংহাসনে আরােহণ করেন রাজারাম (১৬৮৯খ্রিস্টাব্দে )।
  • রাজারাম ছিলেন শম্ভুজীর ছোটভাই।
  • তিনি মারাঠা সিংহাসনে বসেননি এবং দাবি করতেন যে তিনি শাহুর পরিবর্তে শাসনকার্য চালাচ্ছেন।
  • তিনি তার রাজধানী গিন্জীতে স্থাপন করেন।
  • মুঘলরা গিন্জী দখল করলে তিনি প্রথমে বিশালগড় এবং পরে সাঁতারাতে পালিয়ে যান পেশোয়া হুকুমত সিংকে শাসনের দায়িত্ব দিয়ে।

১৭০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা গেলে তাঁর বিধবা পত্নী তারাবাই তাঁর শিশুপুত্র দ্বিতীয় শিবাজীকে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁর নামে নিজেই শাসনভার গ্রহণ করেন। তারাবাঈয়ের শক্তিবৃদ্ধি হতে দেখে জুলফিকার খান মারাঠাদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব লাগানোর উদ্দেশ্যে শাহুকে মুঘল বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেন ।

শাহু ( ১৭০৭- ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ )

  • মুঘলরা মারাঠাদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং তারাবাই ধানাজি যাদবকে পাঠান শাহুকে দমন করতে।
  • ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে বালাজি বিশ্বনাথের সহযোগিতায় শাহু খেদের যুদ্ধে তারাবাইকে হারিয়ে সাতারা দখল করেন এবং সাতারার সিংহাসনে বসেন।
  • পরাজিত হয়ে তারাবাঈ তার শিশুপুত্রকে নিয়ে কোলহাপুরে চলে যান।
  • শাহুর শাসনকালে বালাজি বিশ্বনাথের ক্ষমতা ক্রমশ বাড়তে থাকে ।
  • ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে শাহু বালাজি বিশ্বনাথকে পেশোয়ার পদে নিযুক্ত করেন।
  • বালাজি বাজিরাও-এর সময় মারাঠা রাজা শাহুজি প্রয়াত হন ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে।
  • শাহু মৃত্যুর আগে রামরাজকে রাজা হিসেবে মনোনীত করেছিলেন ।